আলোচনা করি, ভিন্নমত বিবেচনায় নিই

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বাংলা - Bangla - NCTB BOOK

পক্ষে-বিপক্ষে মত প্রকাশ

আকিদ বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার মোড়ে আসতেই একটু হকচকিয়ে গেল। দুজন লোক একটা বিষয় নিয়ে তর্ক করছে। আকিদ একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করল। রাস্তার মোড়ে কয়েক দিন ধরে কে বা কারা ময়লা ফেলছে। এই ময়লা ফেলা নিয়েই তর্কের সূত্রপাত। তাদের কথা শুনে আকিদ বুঝতে পারল, দুজনেই এই এলাকার বাসিন্দা এবং পরস্পরের পরিচিত। একজনের নাম শাফকাত হোসেন এবং আরেক জনের নাম আজমল করিম।

শাফকাত সাহেব বললেন, 'মানুষজনের দায়িত্ববোধের কি এতই অভাব? রাস্তার মোড়ে কেন ময়লা ফেলবে?'
আজমল সাহেব বললেন, 'মানুষ না হয় ভুল করতে পারে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কী করছে?'
শাফকাত সাহেব একটু ক্ষিপ্ত হলেন। বললেন, 'এলাকা পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব শুধু কর্তৃপক্ষের না। আমাদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্বশীল হতে হবে।'
দুজনের তর্কের মাঝখানে এলাকার আরো কয়েকজন জড়ো হয়ে গেলেন। কয়েকজন শাফকাত সাহেবের পক্ষে এবং কয়েকজন আজমল সাহেবের পক্ষে অবস্থান নিলেন। একজন দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলেন, 'এটা কি ময়লা ফেলার জায়গা? এভাবে ময়লা ফেলতে ফেলতে জায়গাটাকে ময়লার ভাগাড় বানিয়ে ফেলবে সবাই। যত্তসব।' আরেক জন শান্ত গলায় বলার চেষ্টা করলেন, 'এখানে আগে কখনো ময়লা ফেলতে দেখিনি। আশা করি, বিষয়টা কর্তৃপক্ষের নজরে পড়বে এবং আজ-কালের মধ্যেই হয়তো ময়লা পরিষ্কার করে ফেলবে।' সাদা শার্ট পরা একজন বললেন, 'আমাদের আবর্জনা ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে হবে। শুনেছি বিদেশে একেক রকম ময়লার জন্য একেক ধরনের ব্যঙ্গ থাকে। আর আমরা যা পাই, সব এক জায়গায় ফেলি।'

উপরের নমুনার পরিপ্রেক্ষিতে তুমি কী মনে করো? এলাকা পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব কি ব্যক্তির না কর্তৃপক্ষের? এ বিষয়ে শ্রেণিতে তোমার মত প্রকাশ করো। এরপর একই বিষয়ে সহপাঠীদের মত নাও। তাদের কোনো ভিন্নমত থাকলে তাও বোঝার চেষ্টা করো। অন্যদের মতের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনে নিজের মত সংশোধন করে আবার উপস্থাপন করো।

 

ক) তোমার বক্তব্যের পিছনে কী কী যুক্তি আছে?

_______________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________

খ) তোমার সহপাঠীদের কোন কোন কথার সাথে একমত এবং কোন কোন কথার সাথে একমত নও?

_______________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________

গ) সহপাঠীদের ভিন্নমত প্রসঙ্গে তোমার বক্তব্য কী?

_______________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________

ঘ) আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তোমার মতের কোনো পরিবর্তন করতে চাও কি না? কেন চাও, কিংবা চাও না?

_______________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________

 

এই আলোচনার সময়ে নিচের বিষয়গুলো কতটুকু বজায় রাখতে পেরেছ, তা যাচাই করো।

মত ও ভিন্নমতবিবেচ্যহ্যাঁ/না
মত প্রকাশআলোচনার বিষয়টি ভালো করে বুঝে নিয়েছি। 
যুক্তিগুলো সাজিয়ে নিয়েছি। 
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে উদাহরণ দিতে পেরেছি। 
নির্ভরযোগ্য তথ্য ব্যবহার করেছি। 
ভিন্নমত প্রকাশমতের বিপরীতে যুক্তি দিতে পেরেছি। 
নির্ভরযোগ্য তথ্য ব্যবহার করতে পেরেছি। 
ভিন্নমত গ্রহণভিন্নমতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা মুক্তি পেয়েছি 
প্রয়োজনে নিজের মত পরিবর্তনের ব্যাপারটি বিবেচনায় রেখেছি। 

 

আলোচনা-সমালোচনা

মানুষ একজন আরেক জনের সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলে। যখন সে কোনো বিষয়ের উপর নিজের মত প্রকাশ করে এবং একইসাথে অন্যের মত শোনে, তখন তাকে আলোচনা করা বলে। এই আলোচনার সময়ে একজন চাইলে আরেকজনের মতের বিপরীতে গিয়ে কথা বলতে পারে। এই বিপরীত মতকে ভিন্নমত বলে। ভিন্নমত প্রকাশের সময়ে নিজের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে হয়। আলোচনার সময়ে নিজের মত প্রকাশ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভিন্নমতকে গ্রহণ করতে পারাও গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে কোনো ধারণা অধিকতর স্পষ্ট হয়। ভিন্নমত গ্রহণ করতেই হবে, এমন নয়। তবে মতের অমিল থাকলেও অপরের মতকে শ্রদ্ধা করতে হয়। ভিন্নমতের যুক্তিকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়। কারণ, প্রত্যেকের মতের পিছনে তার নিজের ধারণা ও যুক্তি থাকে।

আলোচনায় অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়ে কথা বলেন। ফলে, যত বেশি আলোচনা হয়, তত বেশি তথ্য জড়ো হয়। এসব তথ্য বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় যুক্তি। এই যুক্তি ব্যবহার করে আলোচকগণ তাঁদের নিজ নিজ মত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। নিজের যুক্তিতে ব্যবহারের জন্য তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সংগ্রহ করতে হয়। অন্যের তথ্য কতটুকু সঠিক, তাও নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে যাচাই করে নেওয়া যেতে পারে।

নিজের যুক্তি ও মত প্রকাশের সময়ে আত্মপ্রত্যয়ী থাকতে হয়। তবে শব্দপ্রয়োগ ও অঙ্গভঙ্গি এমন হওয়া ঠিক নয় যা অন্যের মনঃকষ্টের কারণ হয়। মনে রাখতে হবে, সব আলোচনা থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না-ও পাওয়া যেতে পারে।
আলোচনা-সমালোচনার সময়ে কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয়:

১. শান্ত থাকা: আলোচনার সময়ে শান্ত থাকতে হয়। মত প্রকাশ ও ভিন্নমত প্রকাশের সময়ে আলোচকদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি তৈরি হতে পারে। এই অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে আলোচনা এগিয়ে নিতে হয়। নিজের ব্যাপারে সমালোচনা শুনলে প্রথমেই মানুষ আত্মপক্ষ সমর্থন করার চেষ্টা করে। এই চেষ্টার ফলে তৈরি হয় রাগ ও অন্যান্য নেতিবাচক আবেগ। এসব নেতিবাচক আবেগকে পাশ কাটিয়ে শান্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।

২. ভিন্নমতকে ইতিবাচকভাবে দেখা: সাধারণত সমালোচনার মাধ্যমে অনেক ছোটো-বড়ো ভুল ধরা পড়ে। ভুল ধরা পড়াই হলো ভুল সংশোধনের প্রথম পদক্ষেপ। তাই সমালোচককে বন্ধু হিসেবে ভাবতে হবে। 

৩. ভিন্নমত বোঝার চেষ্টা করা: সমালোচক কী বলতে চাচ্ছেন, তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সমালোচককে তার মতামত ব্যক্ত করতে সময় দিতে হবে। সমালোচকের সম্পূর্ণ বক্তব্য শোনার পর সেই বক্তব্যের ইতিবাচক দিকগুলো চিন্তা করতে হবে।

৪. ভিন্নমতের যুক্তিগুলো ভালো করে বুঝে নেওয়া: ভিন্নমতের জন্য সমালোচককে প্রথমেই ধন্যবাদ জানাতে হবে। তার বক্তব্য স্পষ্ট করে বোঝার জন্য প্রয়োজনে তাকে কিছু প্রশ্ন করা যেতে পারে।

৫. নিজের ভুল স্বীকার করা: অন্যের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষেতে নিজের মতের কোনো পরিবর্তন আনতে চাইলে তা আনা উচিত। এমনকি, নিজের বক্তব্যে কোনো ভুল থাকলে সেটিও স্বীকার করে নিতে হয়।

৬. ইতিবাচকভাবে শেষ করা: আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো না-ও যেতে পারে। তা সত্ত্বেও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা শেষ করতে হবে। আলোচনার পুরো সময় জুড়ে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা উচিত।

 

বইয়ের আলোচনা

কোনো একটি বই নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এই আলোচনা লিখিত হতে পারে, মৌখিকও হতে পারে। বইয়ের আলোচনা করার আগে বইটি ভালোভাবে পড়ে নিতে হয়। একটি বইয়ের আলোচনা একজন করতে পারে; আবার একই বই নিয়ে কয়েকজন দলগতভাবেও আলোচনা করতে পারে।
এখানে হুমায়ুন আহমেদের 'আগুনের পরশমণি' বইটির উপর একটি লিখিত আলোচনা দেওয়া হলো:
বইয়ের নাম: আগুনের পরশমণি
লেখক: হুমায়ূন আহমেদ
প্রকাশক: বিদ্যাপ্রকাশ, ঢাকা
প্রকাশকাল: ১৯৮৬
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
মূল্য: ৪৫ টাকা।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা 'আগুনের পরশমণি' একটি উপন্যাস। এটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত। উপন্যাসটিতে মাত্র কয়েক দিনের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। ঢাকা শহরে একদল গেরিলা যোদ্ধা ঢুকে পড়ে এবং তারা কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেয়। এটি উপন্যাসের মূল কাহিনি।
বদিউল আলম এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে গেরিলা দলের প্রধান। অপারেশন সম্পন্ন করার জন্য সে ঢাকা শহরে একজন সরকারি কর্মচারীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এই কর্মচারী হলেন মতিন সাহেব, যিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে ঢাকার একটি একতলা বাড়িতে থাকতেন।
উপন্যাসে অবরুদ্ধ ঢাকার চিত্র ফুটে উঠেছে। ওই সময়ে পাকিস্তানি মিলিটারি ঢাকা শহরকে পুরো নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। সময়-অসময়ে কারফিউ জারি করে মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করত। কখনো কখনো মানুষকে ধরে, কিংবা বাস থেকে নামিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলত। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল উৎকণ্ঠা ছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার দেখাতে চাইত সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে। কিন্তু বদিউল আলম তার দল নিয়ে ঢাকায় ঢুকে বিভিন্ন অপারেশনের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছে, ঢাকা স্বাভাবিক নেই। দেশের অবস্থা জানার জন্য সাধারণ মানুষ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শোনার চেষ্টা করত।
অপারেশনে অংশ নিতে গিয়ে বদিউল আলম গুরুতর আহত হয় এবং পরে মারা যায়। উপন্যাসের শেষে হুমায়ুন আহমেদ লিখেছেন: 'আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে।' অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার ইঙ্গিতের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

উপন্যাসের কাহিনির মধ্য দিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ের বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে। একইসঙ্গে ঐ পরিস্থিতিতে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কোন পর্যায়ে ছিল তাও ধরা পড়েছে। সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরেও একদল গেরিলা

যোদ্ধা দেশ স্বাধীন করার পিছনে ভূমিকা রেখেছে, তা এই উপন্যাস থেকে জানা যায়।
উপন্যাসের ভাষা সরল। চরিত্রগুলো জীবন্ত। উপন্যাসটির কাহিনির উপর ভিত্তি করে হুমায়ুন আহমেদ একটি
চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছিলেন।
বইয়ের আলোচনা করার সময়ে কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয়; যেমন-

  • বইয়ের লেখক, প্রকাশক, প্রকাশকাল, প্রচ্ছদশিল্পী ইত্যাদি তথ্য দিতে হয়।
  • বইটি কোন প্রেক্ষাপটে রচিত, তা উল্লেখ করতে হয়।
  • লেখকের বক্তব্য বোঝার চেষ্টা করতে হয় এবং তা নিজের ভাষায় লিখতে হয়।
  • বইয়ের ভালো-মন্দ দিকগুলো তুলে ধরতে হয়।
  • বইটির কোনো বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত থাকলে তা উল্লেখ করা যেতে পারে।
    একই বইয়ের উপর লেখা আলোচনা একেক জনের একেক রকম হয়। আবার একজনের আলোচনার সাথে অন্যরা কোনো কোনো জায়গায় ভিন্নমত পোষণ করতে পারে।

বই/গল্প/কবিতা নিয়ে আলোচনা করি

নিজেরা দলে ভাগ হও। শিক্ষকের পরামর্শ নিয়ে একটি বই, গল্প বা কবিতা বাছাই করো। তারপর সেটির উপর একটি আলোচনা লেখো ও দলের সবার সামনে উপস্থাপন করো। একই বিষয়ের উপর দলের অন্যদের আলোচনা শোনো। এরপর পরস্পরের মতের উপর সমালোচনা করো। এভাবে আলোচনা-সমালোচনার পরে নিজের আলোচনাটি নতুন করে লেখো। 

Content added || updated By

আরও দেখুন...

Promotion